দীপক সাহা ( প্রাবন্ধিক ও গল্পকার)
পশ্চিমবঙ্গ
ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭৪ সালের ২৫ শেসেপ্টেম্বর বাঙালি জাতির এক ঐতিহাসিক দিন।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণটি ইতিহাস কাঁপানো এক শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বশান্তি, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ। এর এক সপ্তাহ আগে ১৭ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ সিদ্ধান্তটি তিনি আগেই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল লন্ডনে বাংলাদেশের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরীর ওপর।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের আট দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সাধু বাংলায় কানায় কানায় পূর্ণ জাতিসংঘের হাউসে দেওয়া ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ পর্যায়ে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সম্মানিত সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি আমার বিশ্বাস রহিয়াছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ অসম্ভবকে জয় করিবার ক্ষমতা রাখে।’ বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো যেই সব দেশ দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, কেবল তাহাদেরই এই দৃঢ়তা ও মনোবল রহিয়াছে। মনে রাখিবেন সভাপতি, আমার বাঙালি জাতি চরম দুঃখ ভোগ করিতে পারে, কিন্তু মরিবে না, টিকিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার জনগণের দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান শক্তি।’
এ প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা উল্লেখ করি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি লন্ডনে চলে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখান থেকে ফের ৯ই জানুয়ারি রাতে রওনা হয়ে ১০ই জানুয়ারি দুপুরে দিল্লিতে পৌঁছান তিনি। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে অভ্যর্থনা জানান। শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে আসার খবর শুনে দিল্লি বিমানবন্দরের পাশে হাজার হাজার ভারতীয় নারী-পুরুষ মুজিবকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমায়। সেখানে সংক্ষিপ্ত অভ্যর্থনা সভায় বক্তব্য রাখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণ শুরু করেন ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান প্রেজেন্ট…’ বলতে না বলতেই উপস্থিত হাজার হাজার ভারতীয় দর্শক একসঙ্গে সমস্বরে চিৎকার করে তাকে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। তাদের দাবির মুখে খানিকটা বিব্রত হয়ে পাশে দাঁড়ানো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে তিনিও স্মিত হেসে বলেন, ‘দে নিড বেঙ্গলি’। তিনিও বঙ্গবন্ধুকে বাংলায় বক্তৃতা করার আহ্বান জানান। এরপরে বঙ্গবন্ধু তাঁর মেঘস্বর কণ্ঠে বাংলায় বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি ‘ভাই ও বোনেরা’ বলতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে ভারতের অভ্যর্থনা সভার জনস্রোত।
পূর্ব বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার জলকাদা থেকে উঠে আসা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যখন প্রথমবারের মতো দরাজ গলায় বাংলায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি শুরু করেন, তখন বাঙালির ইতিহাসের আরেকটি দরজা খুলে গেল। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শুরু থেকে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। জেল খাটেন। অনশন করেন। তাঁর মূলধারার রাজনীতিরও কেন্দ্রে ছিল বাংলা ভাষার মর্যাদার ইস্যুটি। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাই সর্বত্র মাতৃভাষার প্রয়োগে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাই জাতিসংঘে তাঁর মুখ থেকেই প্রথম বাংলা ভাষা উচ্চারিত হবে—সেটাই ছিল স্বাভাবিক। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার এই অধিষ্ঠান তাই বাঙালির গর্বের অংশ। সেদিনও তিনি দৃপ্ত পায়ে হেঁটে বিশ্ব মহাসভায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল’ গ্রন্থে শাহরিয়ার ইকবাল (উত্তরবঙ্গ প্রকাশনী ২০০০) লিখেছেন, ” তিনি স্বভূমির মাটিতে দাঁড়িয়ে বিপুল বিশ্বের আকাশ থেকে নিঃশ্বাস নিতেন। বাঙালির বঙ্গবন্ধু চেতনায় ও দর্শনে ছিলেন বিশ্ব মানবতার পরম বন্ধু। সে কারণেই তাঁকে বলা হয় বিশ্ববন্ধু।”
বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লড়াই এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের শিক্ষাকে তিনি সহজেই বিশ্বপর্যায়ের শান্তি ও সমৃদ্ধির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন। হৃদয়ের গহিন তল থেকে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন—মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। ‘কারো প্রতি শত্রুতা নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্বের’ আহ্বানের মধ্য দিয়ে তাঁর শান্তির অন্বেষার কূটনৈতিক নির্দেশনা রেখে গেছেন। এই অক্ষয় ভালোবাসার কথা বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে সেদিন হৃদয়গ্রাহী এক ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
এ ভাষণ ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সোচ্চার এক কণ্ঠস্বর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ। জাতিসংঘে বাংলাভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন, আর এই ভাষাভাষী মানুষ পেয়েছে গর্ব করার অবকাশ। বিশ্ব পরিসরে বঙ্গবন্ধুর আগে বাংলা ভাষাকে এমন করে কেউ পরিচয়ও করিয়ে দেননি। মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেওয়ার বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি ছিল তার সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
বিশ্ব মানবতার পরম বন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতার জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টার জন্মশতবার্ষিকীর পুরো বছরটি বাংলাদেশের সরকার ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করেছে। হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনে যখন বাংলা ভাষা বিপন্ন তখন জাতিসংঘের মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর এই কালজয়ী ভাষণে প্রস্ফুটিত প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি স্বপ্নই হোক বাঙালির আগামীর পথচলার কাঙ্ক্ষিত দিকনির্দেশনা। সেটিই হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি বাঙালি জাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি।
Leave a Reply